আজ ২৫ জানুয়ারী বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার জনক ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৭তম জন্মবার্ষিকী। বাংলার কৃতীমান পুরুষ ও কালজয়ী এ শিল্পী বাংলা ১২৩০ সনের ১২ মাঘ ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে বাবা রাজনারায়ণ দত্ত, মাতা জাহ্নবী দেবীর ঘরে জন্ম গ্রহন করেন। যশোর জেলা শহর থেকে মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদের তীরে ছায়াঢাকা স্নিগ্ধ কেশবপুর উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রাম সাগরদাঁড়িতে তিনি জন্মেছিলেন। সূত্রে, ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন দত্ত কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি অর্জন করেছিলেন ইংরেজী সাহিত্য। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারী খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষা নিলেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভর্তি হলেন শিবপুর বিশপস কলেজে। এখানে তিনি গ্রীক, ফার্সি, জার্মান, ইতালি, ল্যাটিন এবং সংস্কৃত ভাষা শেখেনে। এছাড়াও তিনি হিব্রু, তেলেগু, হিন্দুস্থান ও তামিল ভাষাও জানতেন। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন মাদ্রাজে চলে যান। মাদ্রাজে অবস্থানরত আট বছরে তিনি শিক্ষক, কবি ও সাংবাদিক হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। পত্রিকা সম্পাদনাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশে ডাক পেতেন তিনি। এখানে অরফ্যান এসাইলাম বিদ্যালয়ে ইংরেজী শিক্ষক থাকাকালীন রেবেকা ম্যাকটাভিসকে বিয়ে করেন। কবির এই দাম্পত্য জীবন সুখের না হলেও তিনি চার সন্তানের জনক হয়েছিলেন। সংসার জীবনের পাশাপাশি এমেলিয়া হেনরিয়েটা সোফিয়া নামক ইংরেজ কন্যার সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। এই সম্পর্ক পরবর্তীতে হেনরিয়েটাকে কবির জীবন সঙ্গিনীর মর্যাদা দেন। এই সময় ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দের কবির মা মারা যান। মায়ের স্নেহভরা গভীর ভালবাসা হারিয়ে কবি ভেঙ্গে পড়েন। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে দ্বিতীয় শিক্ষকের পদ গ্রহণ করলে জীবনে আবার গতি ফিরে আসে। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুন কবি ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ডে যান। ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ছেড়ে যান প্যারিসে। এখানে কবিকে আর্থিক দৈন্যতা জেঁকে বসল। ওই সময় বিভিন্ন ব্যক্তি তাকে সহযোগীতা করেছেন। ১৭ নভেম্বর ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে কবির স্বপ্নচারী সাধ পূরণ হয়। তিনি ব্যারিষ্টারি পাশ করেন। ফিরে এসে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা ভাল না লাগায় চাকুরী নেন সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগে অনুবাদের পরীক্ষক পদে। মাসিক দেড় হাজার টাকা বেতনের এ চাকুরী তিনি দুই বছরের মাথায় ছেড়ে দেন। পুনরায় শুরু করেন আইন ব্যবসা। ব্যারিষ্টার হলেও কোর্টের আইনযুদ্ধ তাঁর ভাল লাগেনি। কোর্ট ছেড়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের চাকুরী নিলেন মালভূমে প কোট রাজার আইন উপদেষ্টা পদে। বাংলা ভাষায় আধুনিক সাহিত্যের বহুমাত্রিক সূচনা হয় মধুসূদন দত্তের কলম থেকে। নতুন জীবনমন্ত্র, তেজ ও বীর্যের পূর্ণ বেগ নিয়ে মধুসূদনের আবির্ভাব ঘটেছিল ঊনিশ শতকে। তাঁর জীবন আর কর্ম দুই-ই বর্ণময়। তিনি নিজে যেমন ছিলেন বিস্ময়কর মানুষ, তেমনি তাঁর সাহিত্যেও বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’ অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত প্রথম বাংলা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন ১৮৫৯- ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে। মধুসূদন শরীরের প্রতি অত্যাধিক অত্যাচার করার ফলে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় পরিবারসহ কবিকে বেনেপুকুরের বাড়ি নিয়ে এলেন। মুমূর্ষু অবস্থায় কবিকে ভর্তি করা হয় আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। ২৬ জুন কবির জীবন সঙ্গিনী হেনরিয়েটা মারা যান। স্ত্রীর মৃত্যু সংবাদ কবিকে নীরব করে দেয়। শারীরিক অসুস্থতা আর মানসিক কষ্টে তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। মাত্র কয়েকদিন পর ২৯ জুন রবিবার বেলা দুটোয় মহাকবি মধুসূদন বিদায় নেন পৃথিবী থেকে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যুগস্রষ্টা কবি মধুসূদনের জীবন, দেশপ্রেম, সাহিত্য অধ্যয়ন, সাহিত্যের মর্মবাণী ও মূল্যবোধ মূল্যায়ণ ও তা প্রচার লক্ষ্যে ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ২৬ অক্টোবর তদানীন্তন সরকার কবির বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করেন। বাড়িটি সংরক্ষণের আওতায় এনে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ তা সংস্কার করেন। ১৯৯৬-২০০১ খ্রিস্টাব্দে বাড়ির এলাকাটি দেয়াল বেষ্টিত করে কুটিরের আদলে একটি গেট, একটি ম , দুটি অভ্যর্থনা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এ সময় বাড়ির সমূদয় স্থাপনা পুনঃসংস্কার করে বর্তমান রূপ দেয়া হয়। কবির স্মৃতিকর্ম ঘিরে মধুপল্লীতে গড়ে ওঠে জেলা পরিষদ, ডাকবাংলো, সাগরদাঁড়ি পর্যটন কেন্দ্র, মধুসূদন মিউজিয়াম ও পাবলিক লাইব্রেরী। কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সাগরদাঁড়িতে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলা প্রশাসন প্রতিবছর সপ্তাহব্যাপী মধুমেলার আয়োজন করেন। কিন্তু মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে এবছর মেলার আয়োজন করা হয়নি। যেখানে রয়েছে মধুসূদনের স্মৃতি বিজড়িত পৈত্রিক বাসভবন, মধুপলল্লী, কপোতাক্ষ নদ, বিদায় ঘাট, মধুউদ্যান, জেলা পরিষদ, পর্যাটন কেন্দ্র, কাঠ বাদাম গাছসহ বিভিন্ন ফুল ও ফলের গাছ। তাকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ, পার্ক, একাডেমী, জাদুঘর ও মিনি চিড়িয়া খানা। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু তাঁর সাহিত্য প্রেমিরা ভালবাসার টানে ছুটে আসেন এই অপূর্ব প্রাকৃতিক লীলাভূমি কপোতাক্ষ নদের তীরে অবস্থিত সাগরদাঁড়িতে।
নিউজবিজয় / এফএইচএন
You must log in to post a comment.